টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনে বিএআরআই উদ্ভাবিত
ফলের ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি
ড. বাবুল চন্দ্র সরকার
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কৃষি একটি অনন্য ভূমিকা পালন করছে এবং খোরপোশের কৃষি থেকে বাণিজ্যিক কৃষিতে উন্নয়ন ঘটছে। চাহিদার বিপরীতে ফলের উৎপাদন এখনও অনেক কম। ফল বিভাগ, উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, বিএআরআই কর্তৃক পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ও উন্নয়ন অভীষ্ট লক্ষ্য (এসডিজি) গবেষণার মাধ্যমে উদ্ভাবিত ফলের উচ্চফলনশীল, পুষ্টিসমৃদ্ধ জাত, উন্নত উৎপাদন প্রযুক্তি, সংগ্রহোত্তর এবং ভ্যালু চেইন ব্যবস্থাপনার উপর উদ্ভাবিত প্রযুক্তিসমূহ মাঠ পর্যায়ে বিস্তারের মাধ্যমে দেশে বছরব্যাপী ফলের উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সে সাথে জনগণের পুষ্টি চাহিদা পূরণ হচ্ছে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হচ্ছে। অন্যান্য ফসলের তুলনায় ফল চাষ করে কম জমি থেকে বেশি আয় করা সম্ভব এবং দানাশস্যের তুলনায় উচ্চমূল্যে বিক্রয় করা যায় বিধায় ফল চাষ বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক সময়ের কিছু তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায় যে, উদ্যানতাত্ত্বিক ফসল বিশেষত ফল উৎপাদনে বাংলাদেশে বিগত এক যুগে ফল বিপ্লব সাধিত হয়েছে। বাংলাদেশ বর্তমানে আম উৎপাদনে বিশ্বে ৭ম ও পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম স্থানে রয়েছে।
বিএআরআই উদ্ভাবিত ফলের কিছু প্রতিশ্রুতিশীল ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি
আমের ফুল ও ফল ঝরা রোধে টেকসই ব্যবস্থাপনা : গাছের বয়স অনুসারে তিন কিস্তিতে নির্দেশিত মাত্রার সার প্রয়োগ করতে হবে প্রথম কিস্তি (সম্পূর্ণ জৈবসার, টিএসপি, জিপসাম, জিংক সালফেট ও বরিক এসিড এবং অর্ধেক ইউরিয়া ও অর্ধেক এমওপি সার) ১৫-৩০ সেপ্টেম্বর এর মধ্যে প্রয়োগ করতে হবে। অবশিষ্ট ইউরিয়া ও এমওপি সার সমান দুই ভাগ করে এক ভাগ (দ্বিতীয় কিস্তি) মার্চ মাসের শেষ সময়ে যখন ফল মটর দানার মতো হয় তখন এবং অবশিষ্ট ইউরিয়া ও এমওপি সার এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ থেকে মে মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে অথবা আম সংগ্রহের এক মাস পূর্বে প্রয়োগ করতে হবে। একটি পূর্ণবয়স্ক আম গাছে (১১-১৫ বছর) গোবর ৫২ কেজি, ইউরিয়া ১৭৫০ গ্রাম, টিএসপি ৮৭৫ গ্রাম, এমওপি ৭০০ গ্রাম, জিপসাম ৬১২ গ্রাম, জিংক সালফেট ২৬ গ্রাম এবং বরিক এসিড ৫২ গ্রাম প্রয়োগ করা আবশ্যক। সার প্রয়োগের পর হালকা সেচ দিতে হবে।
গাছে সম্পূর্ণরূপে ফুল প্রস্ফুটিত (ঋঁষষ নষড়ড়স) হবার পর থেকে শুরু করে, ১৫ দিন অন্তর আম গাছে ৪ বার সেচ দিতে হবে। আমের হপার পোকা দমনের জন্য ইমিডাক্লোপ্রিড গ্রুপ এর কীটনাশক; কনফিডর ৭০ ডব্লিউজি, প্রতি লিটার পানিতে ০.২ গ্রাম এবং এনথ্রাকনোজ রোগ দমনের জন্য ম্যানকোজেব গ্রুপ এর ছত্রাকনাশক; ইন্ডোফিল এম-৪৫ প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম, একসাথে মিশিয়ে, ২ বার; মুকুল বের হবার পর কিন্তু ফুল ফোটার আগে ১ বার এবং ফল মটরদানা আকৃতিতে আরেকবার প্রয়োগ করতে হবে।
অমৌসুমে ড্রাগন ফল উৎপাদন কৌশল : ড্রাগন ফল দীর্ঘ দিবসী উদ্ভিদ হওয়ার কারণে ফুল ও ফল উৎপাদনের জন্য দিনের দৈর্ঘ্য ১২ ঘণ্টা বা তার বেশি হওয়া প্রয়োজন। যে কারণে, এপ্রিল মাসের শেষ থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত সাধারণত ড্রাগনফল গাছে ফুল ও ফল উৎপন্ন হয়। তবে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত যখন দিনের দৈর্ঘ্য কম থাকে তখনও সন্ধ্যার আগ মুহূর্ত থেকে বৈদ্যুতিক বাতির আলোর ব্যবস্থা করে কৃত্রিম উপায়ে দিনের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধির মাধ্যমে ড্রাগনফল গাছে ফুল ও ফল উৎপাদন করা যায়। সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত প্রযুক্তি অনুযায়ী দেখা যায় যে, অক্টোবর হতে মার্চ মাস পর্যন্ত বিকাল ৪টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত পূর্ণবয়স্ক ড্রাগন ফল গাছে বিভিন্ন তীব্রতা সম্পন্ন বৈদ্যুতিক বাতির আলোর প্রয়োগ করা হলে, আলো প্রয়োগের ১২ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে গাছে অমৌসুমি ফুলের কুঁড়ি দেখা যায়, যা হতে ১৫-২০ দিনের মধ্যে ফুল ফোটে এবং তার ২২-৩০ দিনের মধ্যে ফল আহরণ করা যায়। বৈদ্যুতিক বাতি হিসেবে ১০০ ওয়াট সাধারণ বাল্ব, ৩৫ ওয়াট সিএফএল (এনার্জি সেভিং) বাল্ব ও ২০ ওয়াট এলইডি বাল্ব কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যাবে।
স্ট্রবেরি উৎপাদনে সার প্রয়োগের মাত্রা : প্রতি হেক্টর জমিতে ১২০ কেজি নাইট্রোজেন, ৭০ কেজি ফসফরাস, ১২০ কেজি পটাশিয়াম এবং ৪০ কেজি সালফার ব্যাবহার করে স্ট্রবেরি চাষ করলে অধিক ফলন ও গুণগতমানসম্পন্ন স্ট্রবেরি উৎপাদন সম্ভব। ছাদে ১২ ইঞ্চি টবে ৫০% মাটি ও ৫০% পোল্ট্রি লিটার ব্যবহার করে স্ট্রবেরির খুব ভালো ফলন পাওয়া সম্ভব।
কাঁঠালের গ্রাফটিং প্রযুক্তি : বছরের অন্যান্য সময় গ্রাফটিং করা গেলেও সাধারণত অক্টোবর-নভেম্বর এবং জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস গ্রাফটিং এর সবচেয়ে বেশি উপযোগী। ক্লেফট গ্রাফটিং, ভিনিয়ার গ্রাফটিং এবং কনটাক্ট গ্রাফটিং পদ্ধতি উত্তম। সাধারণত ৬-১২ মাস বয়সী সতেজ ও রোগমুক্ত চারা রুটস্টক হিসেবে ব্যবহার করতে হবে।
লিচুর অঙ্গজ বংশবিস্তার পদ্ধতি আদর্শীকরণ : লিচুর অঙ্গজ বংশবিস্তারের একটি আদর্শ পদ্ধতি হলো গুটি কলম। গুটি কলম তৈরির ক্ষেত্রে শতকরা ৫০ ভাগ পাতা রেখে একদিন অন্তর পানি প্রয়োগ করলে সর্বোচ্চ সংখ্যক সুস্থ কলম পাওয়া যায়। ৫০ শতাংশ পাতাবিশিষ্ট গুটিগুলোর বৃদ্ধিও অপেক্ষাকৃত ভালো হয়। শিকড় খুব নরম থাকে বলে গুটিগুলোকে ৫০% মাটি ও ৫০% তুষের ছাই দ্বারা পূর্ণকৃত টব বা বেডে আলতোভাবে স্থাপন করতে হবে, যাতে শিকড় আঘাতপ্রাপ্ত না হয়।
লিচুতে ক্লেফট গ্রাফটিং : মে মাসে বারি লিচু-২ ও বারি লিচু-৪ এ ক্লেফট গ্রাফটিং পদ্ধতিতে অধিক সফলতা পাওয়া গেছে।
আমড়ার অঙ্গজ বংশবিস্তার পদ্ধতি আদর্শীকরণ : ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে এক বছর বয়সের রুটস্টকের উপর ৩০-৪০ দিন বয়সের সুস্থ সায়ন (পষবভঃ) এবং স্লাইস (ংষরপব) গ্রাফটিং এর মাধ্যমে জোড়া লাগানো স্থলে শতকরা ৯০ ভাগের অধিক সুস্থ-সবল ও মানসম্পন্ন আমড়া কলম উৎপাদন সম্ভব।
মাল্টার বৃদ্ধি এবং ফলনের জন্য বিভিন্ন ধরনের রুটস্টক নির্ধারণ : চারার বৃদ্ধি, টিকে থাকা, রোগ সংক্রামণ এবং লিফ মাইনার আক্রমণ বিবেচনায় রাফ লেমন সবচেয়ে উপযোগী রুটস্টক। জলপাইয়ের গ্রাফটিং এর সফলতা, টিকে থাকা ও বৃদ্ধির জন্য গ্রাফটিং এর সময় ও পদ্ধতি নির্ধারণ খুব জরুরি। জলপাইয়ের অঙ্গজ বংশবিস্তারের ক্ষেত্রে মে মাসে ক্লেফট বা স্পøাইস গ্রাফটিং পদ্ধতি উত্তম।
জিবরেলিক এসিড (এঅ৩) হরমোন প্রয়োগের মাধমে স্ট্রবেরিতে চারা (ৎঁহহবৎ) উৎপাদন : ১.০ মিলিমোল (১ সগ) মাত্রায় জিবরেলিক এসিড (এঅ৩) সপ্তাহে ১ বারের জন্য স্প্রে করলে প্রতিটি গাছ থেকে সর্বাধিক সংখ্যক রানার (৩.৫টি) ও উপ-রানার (১১.০টি) পাওয়া যায়। অর্থাৎ প্রতিটি মাতৃগাছ থেকে গড়ে ১৫টি চারা উৎপাদিত হয়। এছাড়া ০.৫ মিলিমোল (০.৫ সগ) মাত্রায় জিবরেলিক এসিড হরমোন শুধুমাত্র একসপ্তাহে দুই বার ব্যবহার করলে গড়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক চারা/রানার (৩টি) ও উপ-রানার (৯টি) পাওয়া যেতে পারে।
কাঁঠালের গামোসিস রোগ দমনব্যবস্থা : আক্রান্ত স্থান চাকু দিয়ে চেঁছে পরিষ্কার করে আলকাতরা বা বর্দোপেস্ট (তুঁত-১০০ গ্রাম; চুন-১০০ গ্রাম; পানি-১ লি.) প্রয়োগ করতে হবে।
ব্যাগিং পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে লিচুর ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ রোধকরণ : লিচুতে গুটি ধরার (ভৎঁরঃ ংবঃ) ৪০ দিন পর বাদামি পেপার ব্যাগ দ্বারা ব্যাগিং করলে ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ প্রায় ৯৭ শতাংশ রোধ করা সম্ভব যেখানে ব্যাগবিহীন লিচুতে পোকার আক্রমণ থাকে ২৫ শতাংশ বা তার অধিক।
টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
হাইব্রিড জাত উদ্ভাবনের জন্য ফলের উদ্ভিদ প্রজনন (নৎববফরহম) কার্যক্রম জোরদার করা; দেশ ও বিদেশ থেকে বিভিন্ন ফলের জার্মপ্লাজম সংগ্রহ, বৈশিষ্ট্যকরণ, মূল্যায়ন, সংরক্ষণ এবং নতুন নতুন জাতসহ উন্নত কলাকৌশল উদ্ভাবন; জৈবিক (নরড়ঃরপ) ও অজৈবিক (ধনরড়ঃরপ) ঘাত সহিঞ্চু জাত উদ্ভাবন; অমৌসুমি ও বছরব্যাপী উৎপাদনক্ষম ফলের উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন; ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের সাথে সামঞ্জস্য রেখে উন্নত প্রযুক্তি (যেমন: ন্যানো প্রযুক্তি, দ্রোন এর ব্যবহার ইত্যাদি) উদ্ভাবন; নিরাপদ ফল উৎপাদনের প্রযুক্তি (এঅচ) উদ্ভাবন; জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব মোকাবেলায় সক্ষম এমন প্রযুক্তি উদ্ভাবন; উন্নত গুণগত মানসম্পন্ন মাতৃকলম/চারা উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও বিতরণ কার্যক্রম জোরদার করা; প্রতি বছর স্থানীয় জাতের পরিবর্তে (কম উৎপাদনশীল) উন্নত জাতের পর্যাপ্ত পরিমাণে মানসম্পন্ন কলমের চারার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা; ফলের সংগ্রহোত্তর ক্ষতি হ্রাসকরণের জন্য প্রযুক্তি উদ্ভাবন; শহর এবং শহরতলী এলাকাতে ফল চাষের জন্য প্রযুক্তি উদ্ভাবন; ফলের উন্নয়নের জন্য জীবপ্রযুক্তির ব্যবহার; দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবল তৈরি করা।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন “আমার দেশের প্রতিটি মানুষ খাদ্য পাবে, আশ্রয় পাবে, শিক্ষা পাবে, উন্নত জীবনের অধিকারী হবে-এই হচ্ছে আমার স্বপ্ন”। ফলের আধুনিক প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও উন্নয়নে ফল বিভাগ, উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, বিএআরআই প্রধান ভূমিকা পালন করছে। প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে দেশে নিরাপদ ও গুণগত মানসম্পন্ন ফলের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ফলের গবেষণা ও উন্নয়ন কার্যক্রম আরও জোরদার করা হচ্ছে। অধিকন্তু, দেশে ফলনির্ভর কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে উঠছে এবং কৃষির বাণিজ্যিকীকরণ হচ্ছে। পরিশেষে বলা যায়, ফলের উন্নত জাত ও অন্যান্য প্রযুক্তির যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে মানুষের পুষ্টিচাহিদা মেটানোর পাশাপাশি, বাড়তি আয় ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে, যা দারিদ্র্য দূরীকরণের মাধ্যমে জীবনমানের উন্নয়ন তথা উন্নয়ন অভীষ্ট লক্ষ্য (এসডিজি) লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। তাই আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার ও অধিক ফল চাষের মাধ্যমে ফল উৎপাদন বৃদ্ধি করে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করতে হবে, তবেই বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যে হবে একটি উন্নত সমৃদ্ধ দেশ।
লেখক : মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ফল বিভাগ, উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, বিএআরআই, গাজীপুর। মোবাইল: ০১৭১৬০০৯৩১৯, ই মেইল : নংধৎশবৎথ৬৪@ুধযড়ড়.পড়স